স্বদেশ ডেস্ক:
নানা সংকটের মধ্যেও তিন বছর পরপর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে। এ হিসেবে আগামী সম্মেলন হওয়ার কথা ডিসেম্বরে। বর্তমানে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার বিধিনিষেধ জারি করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গণজমায়েত না করার নির্দেশনাও রয়েছে। এমন বাস্তবতায় দলীয় কার্যক্রম প্রায় স্থবির। বর্তমান কমিটি গত সোয়া ২ বছরে মাত্র ৪টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন করেছে। ডিসেম্বরের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ ৪২টি জেলার সম্মেলন করার ভাবনা রয়েছে দলটির।
এদিকে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও আগস্ট মাস ঘিরে আওয়ামী লীগের থাকে বিভিন্ন কর্মসূচি। এর মধ্যে নতুন বছরের এক মাস গত হতে চলল। সব মিলিয়ে জাতীয় সম্মেলনের জন্য আওয়ামী লীগের হাতে থাকে ৮ মাস। এই সময়ের মধ্যে দলীয় কোন্দল নিরসন, অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণ ও ঠেকানো, মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন ও নতুন কমিটি দেওয়া, সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন করাসহ অনেক কাজ রয়েছে। এত কাজ শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সম্মেলন করাই চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪২টির কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। ২০১৯ সালের সম্মেলনের পর নতুন কমিটি ২ বছরের বেশি সময়ে শুধু রাজশাহী বিভাগে ৩টি জেলা ও ঢাকা বিভাগের একটি জেলার অর্থাৎ মোট ৪টি জেলার সম্মেলন করেছে। কিছু উপজেলায় সম্মেলন হয়েছে। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কোনো জেলা কমিটি হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে ৪২টি জেলার সম্মেলন কীভাবে হবে- এমন প্রশ্নও রয়েছে দলের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্মেলন না হলেও টেলিফোনে ও ভার্চুয়ালি কথা বলে সংগঠন গুছিয়ে আনার কথা ভাবছে দলটি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যেন সম্মেলন করতে পারে সে প্রস্তুতিও রাখা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলায় নতুন কমিটি আনা এবং সেখানে ঐক্য বজায় রাখাও চ্যালেঞ্জ হবে দলের জন্য।
ময়মনসিংহ বিভাগের একজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের গত কমিটি ৩২টি সাংগঠনিক জেলার কমিটি দিয়েছিল। এই কমিটি সোয়া ২ বছরে মাত্র ৪টি কমিটি দিয়েছে। কোভিডের বিষয়টি মাথায় রেখেও রাজশাহী বিভাগে ৩টি জেলার কমিটি হতে পারলে অন্য বিভাগে হতে সমস্যা কী ছিল? নতুন নেতৃত্ব না আনতে পারায় তৃণমূল আওয়ামী লীগে বিশেষ ব্যক্তির ক্ষমতা বাড়ছে আর কিছু কিছু মানুষ কোণঠাসা হচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব আসার পথ বন্ধ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তৃণমূলকে প্রাধান্য দিয়েই আওয়ামী লীগ রাজনীতি করেছে। এটিই আওয়ামী লীগের মূলধারা। দলকে সেই মূলধারায় ফিরে আনাও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা, উপজেলা ও একাধিক উপনির্বাচন ঘিরে তৃণমূল আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব বেড়েছে বহুগুণ। বিশেষ করে ইউপি নির্বাচন ঘিরে স্থানীয় ও কখনো কখনো কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এতে দলের ত্যাগী নেতারা বাদ পড়ায় নির্বাচনে বিদ্রোহীর সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ইউপি নির্বাচনের ৫ ধাপে দলীয় প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহীদের জয়ের সংখ্যা বেশি। নির্বাচন ঘিরে দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর অবস্থান মুখোমুখি হওয়ায় অনেক জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। নিহতের সংখ্যাও শতাধিক। ফলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের এই ক্ষোভ দূর করা এবং দলের প্রতি আনুগত্য ফিরিয়ে আনা দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর, নোয়াখালী, সিলেট জেলা ও মহানগর, সুনামগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর, গাজীপুর জেলা ও মহানগর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কুমিল্লাসহ প্রায় সব জেলায় দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কোন্দল চলছে। আওয়ামী লীগের এই কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কেবল নোয়াখালীর কমিটি ভেঙে দেওয়া ছাড়া চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ দেখা যায়নি। স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্বের চেহারা প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে চলমান ইউপিসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঐকমত্য পোষণ করে ইউনিয়নে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নাম কেন্দ্রে পাঠাতে পারেনি। আবার কোনো কোনো জেলার নেতা কেন্দ্রের নেতাদের পাত্তা দেন না। একটি জেলার সভাপতি আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজ এলাকায় দ্বন্দ্ব বেশি। কেন্দ্রীয় নেতারা স্বচ্ছতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে অন্যান্য জেলার নেতারা তাদের নির্দেশ না মেনে বরং উল্টো প্রশ্ন করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে নিয়োজিত তিন নেতা জানান, তৃণমূলের দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করতে ইতোমধ্যে ৮ বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তম ধাপের মধ্য দিয়ে ইউপি নির্বাচন শেষ হবে। এরপর সাংগঠনিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, মনোনয়ন বাণিজ্য, নির্বাচনে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নেতারা জানান, মার্চ থেকে জুলাই মাসের মধ্যে তৃণমূলের সম্মেলনের কাজ শেষ করাসহ দল গোছানোর কাজ শেষ করা হবে। এরপর প্রস্তুতি নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের। অবশ্য এ সময়ে এত কাজ শেষ পর্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যাবে কিনা এ নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মনে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান আমাদের সময়কে বলেন, ওমিক্রন পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পরই আমরা আমাদের পরবর্তী কাজে নেমে যাব। ডিসেম্বরের সম্মেলনকে সামনে রেখে কাজ করা দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু চাপ তো পড়েছেই। গত দুবছরে আমাদের আরও অনেক সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানোর কথা ছিল। আমরা কিছু সম্মেলন করেও ছিলাম। কিন্তু ওমিক্রন বাড়াতে সেটায় ব্যাঘাত ঘটেছে। তাই ওমিক্রন সংক্রমণ কমে গেলে আমরা আবার শুরু করব।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ওমিক্রনের কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম, তৃণমূলের সম্মেলন- এসব পুনর্বিন্যাস করেছি, তারিখ পরিবর্তন করেছি। ওমিক্রন যখন সহনীয় পর্যায়ে আসবে তখন আবারও তৃণমূলে সম্মেলন, মিছিল মিটিং সমাবেশ এসব কাজে হাত দেব। আপাতত মানবিক কার্যক্রমের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। মানবিক কাজে জড়িত হওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দকে নির্দেশনা দিয়েছি। ইতোমধ্যে এসব কাজ শুরু হয়ে গেছে।
ওমিক্রনের প্রভাব দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে পড়বে কিনা জানতে চাইলে নাছিম বলেন, করোনার কারণে সবকিছুতেই তো প্রভাব পড়ছে। চাপ আছে। সারাবিশে^ই আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন একটা রাজনৈতিক সংগঠন কখনই কোনো চাপের জন্য থেমে থাকেনি, থাকবে না। করোনা আছে এটা স্বীকার করেই আমরা কাজ করছি। হাতে যতটুকু সময় থাকবে তাতে ব্যাপকভাবে কাজ করে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির জায়গায় যেন ঘাটতি না হয় সেদিকে মনোযোগ দেব। তৃণমূলকে সাজিয়েগুছিয়ে সম্মেলন করার মতো প্রস্তুতিতে কোনো অসুবিধা হবে বলে আমরা এখনো মনে করছি না।
দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং নিরসনে দলের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রুপিং ও প্রতিযোগিতা আওয়ামী লীগে আছে থাকবে। এই প্রতিযোগিতা, গ্রুপিং দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে জোরদার করে। কিন্তু গ্রুপিং ও প্রতিযোগিতার নামে কোথাও যদি ভিন্নতার সৃষ্টি হয়, তা হলে এর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেতৃবৃন্দ নেবে। এর মধ্য দিয়েই আমরা দলকে সুন্দরভাবে সাজাতে পারব।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেন, নতুন কমিটি এসে রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী মহানগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও জয়পুরহাটে সম্মেলন হয়েছে। ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ীতে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কমিটি হয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি পাবনা, ২০ ফেব্রুয়ারি নাটোর, ২৮ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে।